খবর প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:২০ এএম
পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয়করণ করে কতৃত্ববাদী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা বস্তুত এক দলীয় শাসন কায়েম করেছিল । ২০০৮ সালে ২৯শে ডিসেম্বর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসন পেয়ে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ । ভারতীয় মধ্যস্তায় তৎকালীন সেনাপ্রধান এম ইউ আহমেদ আর আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাছিনার মধ্যে তৈরি হয়েছিল গোপন আঁতাত । তারা ছয় মাস ধরে ছক করতে থাকে কীভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা যায় । তারা সফল হয় । নির্বাচনের কয়েক দিন আগে, তৎকালীন যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ারটি দূতাবাসে কর্মরত রাজনৈতিক কনসালট্যান্ট ফিরোজ আহমেদকে সাথে নিয়ে হেলিকপ্টারে গিয়েছিলেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কনষ্টিটুয়েন্সি রাউজানে । ওদের দেখে সালাউদ্দিন চৌধুরী বললেন, দেখুন আপনারা আমার এলাকায় প্রায় যুদ্ধাবস্থা । ফিরোজ জানায়, তারা দেখেছে সাঁজোওয়া গাড়িতে সেনাবিহিনীর পাহারা । সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, সেনা বাহিনী বিএনপি সমর্থক চেয়ারম্যান, মেম্বার, বিএনপি সদস্যদের এলাকা ছাড়া করেছে । রাউজান থেকে ওরা চলে যায় পার্শ্ববর্তী কনষ্টিটুয়েন্সিতে । ওই কনস্টিটুয়েনসির আওয়ামি লীগ প্রার্থী ছিলেন হাসান মাহমুদ (প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী) । সেখানে ছিল উল্টো চিত্র । অর্থাৎ সেনা বাহিনীর কোন লোকই ছিল না । হাসান মাহমুদের পক্ষে আওয়ামি লীগের নির্বাচনী প্রচার চলছিল অবাধে ও জোরেশোরে, বলেন ফিরোজ । অনেক পরে একটা অনুসন্ধানে জানতে পারি, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই তৎকালীন একজন ডিজিএফআই ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার (এখন অবসরপ্রাপ্ত) আমিনকে নির্বাচনী ছক বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । শুধু তাই নয় । আমিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের অনেককে নির্বাচনোত্তর সরকারে মন্ত্রী বানানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন । এসব কথা আমাকে জানিয়েছিলেন দিলীপ বড়ুয়া, সাম্যবাদী দলের নেতা ।
নির্বাচনের আগে আমার অফিসে এসেছিল দিলীপ বড়ুয়া । আমিনের সাথে তার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল । সরকার গঠন হলে আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এম এ জলিল অভিযোগ করেছিলেন, হাছিনা কেবিনেটের অধিকাংশ সদস্যই ডিজিএফআইয়ের লোক । ক্ষমতায় এসে হাছিনা একটানা ১৫ বছর স্বৈরিশাসন চালিয়ে গেছে । তিনটি নির্বাচন করেছে ভোটার ছাড়া । হাছিনা সরকারের চিহ্নিত শত্রু ছিল বিএনপি ও জামাতে ইসলামী । তাই তাঁদর রুখতে হাসিনা সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল । পুলিশ, RAB, BGB, সেনা বাহিনী, আনসার, DGFI, Detective Police, ছাত্র লীগ, যুব লীগ সহ আরো অনেক বাহিনী নিয়ে গড়ে তুলেছিল সুদৃঢ় রক্ষা বেষ্টনী । ওই সব বাহিনীর বিরুদ্ধে বিএনপি, জামাতে ইসলামী প্রাণপণে লড়াই করেছে । নেতা কর্মীরা অকাতরে জীবন দিয়েছে, শিকার হয়েছে গুম, হত্যা, অঙ্গহানি, জেল জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও অসংখ্য মামলার । ছিল আয়না ঘরের মতো ভয়াবহ গোপন বন্দীশালা । গুম করে আটকে রাখা হয় অসংখ্য প্রতিবাদীকে । এই সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ছিল আওয়ামী পন্থী বিচারকরা, মানে হাছিনার বিচারক বাহিনী ।হাসিনার নিরপত্তা স্ট্রেটেজিতে বিএনপি, জামাতকে ঠেকানো ছাড়া অন্য কোন ফ্রন্ট থেকে কার্যকর চ্যালেঞ্জ আসতে পারে বলে মনে করা হয়নি । ছাত্রদের কাছ থেকেতো নয়ই । চ্যালেঞ্জ করার মতো আরেকটা ফ্রন্ট অবশ্য ছিল - শক্ত ফ্রন্টই বটে । আমি সেনা বাহিনীর কথা বলছি । আওয়ামী লীগ সেনা বাহিনীকে ভয় করতো । তবে সেই ভয় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তৎকালীন সেনা প্রধান এম ইউ আহমেদ । হাসিনা-এম ইউ আহমেদ গোপন আঁতাতের ভিত্তিতে BDR ক্যাম্পে প্রকাশ্যে দিবালোকে হত্যা করা হয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে, এই হত্যা কান্ডের প্রতিবাদ করায় এবং হাছিনা সরকারের সমালোচনা করায় চাকরিচ্যূত হয় শত শত সেনা কর্মকর্তা । অনেকে গুম হয়, বন্দী হয় আয়নাঘরে । সেনা বাহিনীর বিধি বিধান উপেক্ষা করে পদোন্নতি দেওয়া হয় এম ইউ আহমেদের অনুগত ও আওয়ামী পন্থী সেনা কর্মকর্তাদের এবং নতুন করে কমিশন দেওয়া হয়েছিল ছাত্র লীগ কর্মীদের । হাছিনার পরীক্ষিত অনুগতদের নিয়ে পুনর্গঠন করা হয় ডিজিএফআই । অধিকন্তু ছিল বর্ধিত সুযোগ সুবিধাদি । তাছাড়াও ক্যান্টনমেন্টে ছিল RAW এজেন্টরা । তাই সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন চ্যালেঞ্জ আসতে পারে বলে মনে করেনি স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ।
ছাত্রদের চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মতো সংগঠিত শক্তি হিসেবে গণ্য করেনি শেখ হাসিনা ও তার পরামর্শদাতারা । প্রথমত: ছাত্ররা জাতীয়ভাবে সংগঠিত শক্তি নয় । দ্বিতীয়ত: ছাত্রদের ঠেকানোর জন্য ছিল সশস্ত্র ছাত্র লীগ বাহিনী, তৃতীয়ত: কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকাংশ ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে ছিল । তাই ফ্যাসিস্ট হাছিনা সরকার নিশ্চিত ছিল, ছাত্রদের যে কোন আন্দোলন সহজেই দমন করতে সক্ষম তার বাহিনী । এক কথায়, এই ফ্রন্ট ছিল পুরোপুরি অরক্ষিত । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু করে হাছিনার কোন উদ্বেগ ছিল না । ছাত্র আন্দোলন থামাতে সশস্ত্র ছাত্র লীগকে লেলিয়ে দেওয়া হলো । ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলা হলো । তারপর শুরু হলো ছাত্রদের বিক্ষোভ । বিক্ষোভ দমানোর জন্য নামানো হলো সব বাহিনী যা এতদিন সরকার ব্যবহার করেছে বিএনপি জামাতের বিরুদ্ধে । বিক্ষোভের তীব্রতা আর সরকারি হামলার প্রচন্ডতা একই হারে বাড়তে থাকে । আন্দোলনরত ছাত্রদের রাজাকার আখ্যা দেওয়া এবং ১৫ই জুলাই আবু সাঈদ সহ ছয় জন ছাত্র হত্যার পর পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটে । ইউটিউবের বদৌলতে মানুষ প্রত্যক্ষ করে রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ - দেখে নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বাহিনীর সশস্ত্র হামলা । RAB, BGB, মিলিটারি, সামরিক বাহিনীর সাজোয়া গাড়ি, সাউন্ড বোমা বিস্ফোরণ, মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ, টিয়ারগ্যাস শেল নিক্ষেপ, হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ - এই সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখছে মানুষ । দেখেছে অতি নিকট থেকে গুলি করে হত্যা । প্রতিক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও আপামর জনসাধারন ছাত্রদের আন্দোলনে শরিক হয় । বিএনপি জামাত ও ইসলমি আন্দোলনের ছাত্র কর্মীরাও প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিল এই আন্দোলনে । গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে । ছাত্রদের দাবি নেমে আসে এক দফায় । এক পর্যায়ে সেনা বাহিনী স্বৈরতন্ত্রের আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায় । ৫ই আগস্ট ঘটে গণঅভ্যুত্থান । আন্দোলনের ৩৬ দিনের মাথায় পতন ঘটে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের । দেশ ছেড়ে পালায় শেখ হাছিনা ।
অনেকে বলছেন রাজনৈতিক দলগুলো যে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে, ছাত্র সমাজ সেই কাজটি করতে সমর্থ হয়েছে ।
এ কথা সত্য । তবে এটাও সত্য হাছিনা সরকার ছাত্রশক্তিকে কখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করেনি । বিএনপি জামাত ঠেকানোর কৌশল ছাত্রদের বিরুদ্ধে কাজে লাগেনি । তাছাড়া যেভাবে হত্যা করা হচ্ছিল ইউটিউবে সেই সব দৃশ্য দেখে সেনা বাহিনীর অনেক সদস্য এবং সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের সমালোচনার মুখে সেনাবাহিনী সরকারের বিপক্ষে চলে যায় । শুনা যায়, ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে সিগন্যাল পেয়েই ৬ তারিখের গণ মার্চ এক দিন এগিয়ে ৫ তারিখ করা হয়েছিল ।
উপসংহারে বলতে হয় , রাজনৈতিক দল ব্যর্থ হয়েছে বলে যারা বলছেন তারা দেশকে একটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন ।