খবর প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:৩২ এএম
আজ মঙ্গলবার ( ২৬ মার্চ ) সকাল ১০টার দিকে সিনিয়র ফ্রেন্ড বীর মুক্তিয়োদ্ধা তোফাজ্জল করিম যখন ফোনে জানালেন যে তিমি সোশাল মিডিয়ায় দেখেছেন প্রফেসর সালাম ইন্তেকাল হয়েছেন তখন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাঁর অসুস্থতার খবর আমার জানা ছিলো, তাঁকে যে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হতো সেটাও জানতাম। আমার সাথে প্রায় নিয়মিতই কথা হতো।তবে বিগত কয়েক মাস থেকে ফোন করে বা মেসেজ দিয়েও তাকে পাচ্ছিলাম না। ৩/৪ মাস আগে ভাবী জানিয়েছিলেন যে প্রফেসর সাহেব সিরিয়াসলি অসুস্থ, নিউমোনিয়া হয়েছিল এবং রিহ্যাবে আছেন। ভাবীকে বললাম কিছুটা সুস্থ হলে যেন আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ করে দেন। আজ জানলাম সেই সুযোগ আর কোনদিনই আসবে না।প্রফেসর সালাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন । আমার বাল্যবন্ধু মাজহার, সাইদ ও মরহুম তারেক উনার ছাত্র ছিলেন। বীর মুক্তিযোদধা মরহুম শেখ কামালও ছিলেন তার ছাত্র। মরহুম তারেক আহমদ এর মাধ্যমে প্রফেসর সালাম সাহেবের সাথে ১৯৭৩ সালে একবার দেখাও হয়েছিল। তারপর ১৯৮৯ সালে আমি আমেরিকায় আসা আব্দি আর কখনো দেখা হয়নি। ১৯৯৫ সালে আমি আমার মরহুম বন্ধু কাজী ফয়সাল আহমেদের সহযোগিতায় ও পরামর্শে ট্যাক্স একাউন্টিং ব্যবসা শুরু করি। তখন কাজী ফয়সালের মাধ্যমেই প্রফেসর সালাম সাহেবের সাথে এই আমেরিকাতেই আবারও নতুন করে পরিচয় ঘটে। প্রফেসর সালাম তখন একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সিপিএ। বিভিন্ন প্রয়োজনে আমি তাঁর অফিসে যেতাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং কোনো কনসাল্টেনসী ফি ছাড়া ফ্রিতেই সাহায্য করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের অনেক গল্প তাঁর সাথে হতো, তার ছাত্রদের সম্পর্কে কথা হতো, বিশেষ করে মরহুম শেখ কামাল সম্পর্কে অনেক কথা বলতেন তার সবই ইতিবাচক । মরহুম শেখ কামাল আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন এবং ১৯৬৯ সনে আমি ও আমার বন্ধুরা বর্তমান ঢাকা সাইন্স কলেজে পড়াকালীন সময়ে পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের মহাবিদ্যালয় কমিটি গঠন করি এবং শেখ কামালের মাধ্যমেই সেটা অনুমোদিত হয়। সে এক ভিন্ন অধ্যায় ।
১৯৯৯ সালে আমি আরও কয়েকজন মিলে দি অপটিমিস্টস্ নামে একটি দাতব্য সংগঠন গঠন করার ভাবনা শুরু করি। প্রাথমিক ভাবে আমি আমার বন্ধু একাউনটেন্ট কাজী ফয়সাল আহমদের পরামর্শে প্রফেসর সারোয়ার বি সালাম সিপিএ সাহেবের পরামর্শ নেই। সাথে আরও ছিলেন মিনহাজ আহমদ, সৈয়দ ইকবাল ও শামিম আহমদ। সালাম সাহেব আমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আমি অবশ্য এটর্নি সৈয়দ নুরুজজামান সিপিএ সাহেবেরও সহযোগিতা নেই। ২০০০ সালের আমাদের সংগঠন দি অপটিমিস্টস্ গঠন হওয়ার পর একাউনটেন্ট কাজী ফয়সাল আহমদ বার্ষিক ট্যাক্স ও ফাইনাসিয়াল রিপোর্ট ইত্যাদি তৈরির দায়িত্ব নেন এবং প্রফেসর সালাম সাহেবের সাহায্য নিয়ে এ কাজগুলি করে যেতে থাকেন। ২০০২ সালে আমরা ইন্টারনেল রেভিনিউ সার্ভিসে ৫০১ (সি) (৩) এর আবেদন করি। এই প্রক্রিয়াতে প্রফেসর সালাম সাহেব সার্বিক সহযোগিতা দেন। পরবর্তিতে এই সংগঠনের ৯৯০ ফাইলিং সহ বার্ষিক অডিটেড ফাইনানসিয়াল প্রতিবেদন প্রফেসর সালাম সাহেব সিপিএ হিসাবে করে যান ২০২২ পর্যন্ত। ২০০৪ সাল থেকে আমি চেষ্টা করতে থাকি প্রফেসর সালাম সাহেবকে সরাসরি আমাদের সংগঠনটিতে জয়েন করানোর জন্য। উনি শত ভাগ সাপোর্ট করতেন তবে সরাসরি যোগ দিতে রাজি হননি। ২০০৬ সালে উনি ঢাকা যাবেন, আমি ও শামিম আহমদ প্ল্যান করে নিলাম ঐ সময়ে ঢাকা যাবার জন্য। ঢাকা পৌছে আমাদের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডাইরেকটর মেজর জেনারেল সালাম চৌধুরীসহ প্রফেসর সালাম সাহেবের সাথে বৈঠক করলাম এবং তাকে ঢাকার কাছাকাছি নারায়নগঞ্জে অপটিমিস্ট্-এর একটি প্রকল্প পরিদর্শন করাতে নিয়ে গেলাম, উনার সাথে ভাবী মিসেস সালামও উপস্থিত ছিলেন। স্পন্সরকৃত ছেলেমেয়েদের ও স্বেচ্ছাসেবকদের দেখে উনার উৎসাহ বেড়ে গেল। উনি ঐ সফরে সিলেটে চা বাগান পরিদর্শন করার আগ্রহ দেখালেন। আমি তাঁকে শান্তিনগর ন্যাশনাল টি কো এর হেড অফিসে নিয়ে গেলাম।ঐ কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেকটর আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই সামছুদ্দিনন চৌধুরী।সে তাকে হবিগঞ্জের চন্ডিচেরা সহ কয়েকটি চা বাগানে সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ভিআইপি অতিথি হিসাবে। উনি আমার ছোট ভাই সামছুদ্দিন চৌধুরীকে খুব পছন্দ করতেন।
পরবর্তিতে ২০০৭ সালে উনি বাংলাদেশে গেলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর সহ আরও ২টি প্রকল্প ভিজিট করে আসেন, আমার ছোট ভাই তাকে ট্রান্সপোর্টপশন সহ কোমপানীর বাংলো ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে দেয়। মৌলভীবাজার সফরে অপটিমিস্ট এর বাংলাদেশের প্রথম ও প্রাক্তন এডিশনাল কান্ট্রি ডাইরেক্টর ডঃ এম এ আহাদ ভাই ও ভাবী দিলশাদ পারভীন প্রফেসর সালাম ও তার স্ত্রী মুরশেদ সালামকে অত্যন্ত সমাদর ও সম্মান করেন। তাদের কথা আমেরিকা ফিরে আমাকে অনেকবার বলেছেন।
আমেরিকায় ফিরে আসার পর আমি তাঁকে প্রস্তাব করলাম আমাদের সংগঠনের মেম্বার হতে। এবার আর উনি আপত্তি করলেন না। আমার দীর্ঘদিনের উদ্দেশ্য সফল হলো। ২০০৮ সালে অপটিমিস্টস্-এর বার্ষিক কাউন্সিলে আমি উপস্থিত সবাইকে জানালাম যে আমি আর সংগঠনের চেয়ারম্যান থাকবো না, আপনারা নুতন চেয়ারম্যান নির্বাচন করুন। সাথে সাথেই মিনহাজ আহমদের প্রস্তাবে ও উপস্থিত সকল সদস্যের সমর্থনে প্রফেসর সারোয়াব বি সালাম দি অপটিমিশটস এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত সিরিয়াসলি সে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তিতে উনার অসুস্থতার জন্য আর কনটিনিউ না করতে চাওয়ায় ২০২২ সাল থেকে মিনহাজ আহমদ চেয়ারম্যনের দায়িত্ব পালন করছেন।
অপটিমিস্ট এর অগ্রগতিতে প্রফেসর সালাম সাহেবের কি অবদান আমি এখানে লিখে শেষ করতে পারব না। অপটিমিষ্টের জন্য তাঁর প্রয়ান এক বড় ক্ষতি। ব্যক্তিগতভাবে আমিও স্বজন হারানোর ব্যাথা অনুভব করছি। বয়সে ১৪/১৫ বছর বড় হওয়ার পরও আমাকে তিনি রানা ভাই বলেই ডাকতেন। প্রতি সপ্তাহেই তিনি আমাকে ফোন করতেন, চ্যারিটি কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য উৎসাহ দিতেন, বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়ে আলাপ করতেন। আমার বন্ধু মরহুম আবদুল জলিল, শাহাবুদ্দীন চৌধুরী ও এম শফিকুর রহমানদেরকে উনি খুব পছন্দ করতেন। প্রতি মাসেই আমরা তাকে দেখতে ব্রুকলিন যেতাম, আমার সাথে বিভিন্ন সময় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে থাকতেন শামীম আহমদ, ফকু চৌধুরী, শাহেদ চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম। অফিসের সামনের একটি রেস্টুরেন্টে আমাদের দুপুরের খাবার না খাইয়ে ছাড়তেন না।
প্রফেসর সালাম সাহেবের মতো একজন অতিশয় সৎ অভিভাবককে হারিয়ে আজ আমি অতিশয় দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছি।
আজ বুধবার ব্রুকলিনের বাংলাদেশ মুসলিম সেনটারে প্রফেসর সারোয়ার বি সালামের জানাজায় মিনহাজ আহমদ, শাহেদ চৌধুরী ও শামীম আহমদ সহ অংশ নিয়ে নিজ অফিসে ফিরে এই পোস্টটি লিখছি। আগামীকাল সকাল ১০টায় লং আইল্যানডের ওয়াশিংটন মেমোরিয়েল পার্কের মুসলিম সেমেটারীতে তাঁকে দাফন করা হবে।আমি অংশ নিতে পারব না, যাওয়া আসা ১২০ মাইলের উপরে, আবহাওয়া ভাল না, এত লং ড্রাইভ আমি এই বয়সে করতে পারি না।
শুধু অন্তর থেকে প্রার্থনা করি এমন সজ্জন, পরোপকারী গুণীজনের পারলৌকিক জীবন প্রশান্তিময় হোক।