NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, সোমবার, এপ্রিল ২৮, ২০২৫ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে একদিন


এম আব্দুর রাজ্জাক প্রকাশিত:  ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে একদিন

এম আব্দুর রাজ্জাক, উত্তরবঙ্গ বগুড়া থেকে : বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। এখানে যুগে যুগে কালে কালে পদধূলি দিয়েছেন কত মনীষী। তাঁদের পদধূলিতে যেমন বাংলাদেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি আমরা পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কোনো না কোনো মনীষী বসবাস করেছেন বা জন্মগ্রহণ করেছেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে কুষ্টিয়ার সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে বেশ কজন মহামানবের সংস্পর্শে। এখানে জন্ম নিয়েছিলেন মরমি ফকির লালন সাঁই, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারসহ আরও অনেকে। আবার এখানে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বরাও।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জমিদারির দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করতেই এখানে এসেছিলেন। এরপর থেকেছেন বহুদিন। কুষ্টিয়ার মাটি এবং নদীর প্রতি কবির মমতার কথা ফুটে উঠেছে তাঁর বহু সৃষ্টিতে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এখনো বহন করে চলেছে কবিগুরুর বহু স্মৃতি। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। দোতলা এই বাড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একসময় এর দোতলার বারান্দায় বসলে একদিকে পদ্মা, অন্যদিকে গড়াই নদী দেখা যেত। ধারণা করা হয়, কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতা ছোট নদী কুষ্টিয়ার গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে লেখা। আপনি যদি কখনো কুষ্টিয়ার বেড়াতে যান, তাহলে এই নদী দেখলে আপনারও সেই কথায় মনে হবে—

 

‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে

 

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’

বিশাল আয়তন এই বাড়ির মধ্যে দোতলা ভবনের পাশে আছে একটি বিশাল দীঘি। পুরো বাড়ির আঙিনাজুড়ে আছে অনেক গাছ। এই গাছগুলোর অবয়ব তাদের বয়সের সাক্ষী দিচ্ছে। এক একটা বৃক্ষ যেন দাঁড়িয়ে আছে এক একজন জাতিস্মরের ভূমিকায়। এই গাছগুলোর মধ্যে আম ও পাইনের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি আছে কাঁঠাল, নিম কাঠবাদামসহ আরও অনেক প্রজাতির গাছ। দীঘির দুই পাড়ে আছে দুটো শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে বসে আপনি বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন। অনেকেই এই শানের ওপর শুয়ে তার শীতল পরশে শরীরের ক্লান্তি জুড়িয়ে নেন। আর দামাল ছেলেরা দল বেঁধে লাফিয়ে নেমে পড়ে গোসল করতে। আরও আছে অধুনালুপ্ত একটা পাতকুয়া।

দোতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে রাখা আছে কবিগুরুর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব। আছে ইতিহাসের সাক্ষী অনেক আলোকচিত্র। পালকি, সিন্দুক, খাটের পাশাপাশি আছে কবিগুরু ব্যবহৃত বজরা। এগুলো দেখলে আপনার মনে হবে আপনি যেন আজ থেকে শত বছর আগে কবিগুরুর সময়ে চলে গেছেন।

যেখানে কবি বাড়ির মেয়েরা পালকিতে করে নৌকা থেকে এই কুঠিবাড়িতে এসে নামছে। সিন্দুকে রাখা আছে তাঁদের ব্যবহৃত তৈজসাদি। আর কবিগুরু খাটে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কখনোবা বজরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন পদ্মার বুকে। ভ্রমণপিপাসু যে কারও কাছে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এক আরাধ্য বস্তু। কুঠিবাড়ির দেয়াল থেকে শুরু করে সবকিছুই আপনার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করবে।বর্তমানে কুঠিবাড়ির অনেক সংস্কার করা হয়েছে। কুঠিবাড়ির সামনে নির্মাণ করা হয়েছে একটা উঁচু মঞ্চ। আর ঢোকার মুখে মূল কুঠিবাড়ির বাইরে দেয়াল তুলে নির্মাণ করা হয়েছে একটা উঁচু প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে প্রবেশ করতে হয়। আর একবারে বাইরে মূল সড়কের পাশে আছে বিভিন্ন সাজ–সরঞ্জাম কেনার দোকান। তার পেছনে আছে অতিথিদের থাকার জন্য ছোট ছোট বাংলো। এই বাংলোগুলোর পাশে সব সময়ই চলে ছোটখাটো মেলা।

সেখানে নাগরদোলা থেকে শুরু করে আছে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা। আর পাওয়া যায় অনেক রকমের মজার খাবার। তার মধ্যে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী কুলফি এবং তিলের খাজা অন্যতম। তবে এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়, বাংলোগুলোর অবস্থান আরও একটা ছোট পুকুরকে কেন্দ্র করে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আদলে। এই পুকুরপাড়ে অনেক আবর্জনা পরিবেশটার সৌন্দর্য একেবারে মলিন করে দিয়েছে। এখানে সেখানে ছড়ানো রয়েছে পলিথিন ব্যাগ।

আমার মনে হয়েছে কর্তৃপক্ষ যদি কয়েকটা রাবিশ বিন দিয়ে দেন, তাহলে আর দর্শনার্থীদের এখানে–সেখানে ময়লা ফেলতে হতো না। দিনের শেষে বিনগুলো পরিষ্কার করে আবার নতুন বিন বসিয়ে দিলে খুব সহজেই এখানকার পরিবেশের সৌন্দর্য ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

ঢাকা থেকে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে অনেকভাবেই যাওয়া যায়। কল্যাণপুরে কুষ্টিয়াগামী বাসগুলোর টিকিট কাউন্টার আছে। আপনি চাইলে আগে থেকেই অনলাইনেও টিকিট কিনে রাখতে পারেন। এরপর বাসে উঠে বসলে একবারে চলে যাবেন কুষ্টিয়া শহরে। কুষ্টিয়া শহরের আছে চমৎকার কিছু হোটেল। আর কুষ্টিয়ার যে কোনো রেস্তোরাঁয় আপনি খেয়ে নিতে পারেন। এরপর কুষ্টিয়া থেকে অটোতে করে শিলাইদহে আসতে পারেন। দুই দিক দিয়ে কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহে যাওয়া যায়। গড়াই সেতু পার হয়ে অথবা ঘোড়ার ঘাট পার হয়ে। কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহে যাওয়ার এ রাস্তাগুলোর পরিবেশও অতি মনোরম। ছায়াঘেরা পাখিডাকা রাস্তাগুলো আপনাকে কবিগুরু সেই গানটার কথায় মনে করিয়ে দিবে—‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে।’