জসিম মল্লিক প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:৫৩ এএম
জসিম মল্লিক
১
আমি সবসময় নিউইয়র্ক যেতে চাই কেনো! আমি তো অন্য কোথাও যেতে পারি। আমি চাইলেই লসএঞ্জেলেস যেতে পারি, হিউষ্টন যেতে পারি, মায়ামি যেতে পারি, ওয়াশিংটন ডিসি যেতে পারি, আটলান্টা জর্জিয়া যেতে পারি, সানফ্রান্সিসকো যেতে পারি, ফ্লোরিডা যেতে পারি, ভার্জিনিয়া যেতে পারি, আটলান্টিক সিটি যেতে পারি, লাস ভেগাস যেতে পারি। কারন এইসব যায়গায় আমার অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু আমি সুযোগ পেলেই প্রথমে নিউইয়র্ক যাওয়ার কথাই ভাবি। এর কারণ নিউইয়র্ক আমি বেশি পছন্দ করি। যারা আমেরিকা ঘুরতে আসেন তাদের কাছে নিউইয়র্ক না এলে আমেরিকা আসাটাই অসম্পুর্ণ থেকে যায়। আমেরিকা মানেই যেনো নিউইয়র্ক। আমিও প্রথম নিউইয়র্ক এসেছিলাম। বিদেশ বলতে নিউইয়র্কের জেএফকে তে নেমেছিলাম।
শৈশবকাল থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমি অনেক ঘুরে বেড়াব। দূর দূরান্তে চলে যাব। যদিও আমার কোথাও কেউ চেনা নাই, কিভাবে যেতে হয় জানিনা। আমার পাসপোর্ট নাই, ভিসা নাই, টাকা পয়সা নাই। কিন্তু স্বপ্ন আছে। ভ্রমণ কাহিনী পড়ে পড়ে স্বপ্ন তৈরী হয়েছিল। প্লেন দেখলেই উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। বিস্মিত হয়ে ভাবতাম পাখির মতো ছোট্ট জিনিসটা গুম গুম শব্দ করে কোথায় যায় কে জানে! কোথা থেকেই বা এসেছে! অবাক কান্ড! আমেরিকা দেশটা নিয়ে আমার অবসেশন তৈরী হয়েছিল তখন থেকেই। স্বপ্ন ছিল একদিন ওই দেশে আমি যাব। বাস্তবে সম্ভব হোক বা না হোক স্বপ্ন দেখতে কোনো সমস্যা নাই। স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না, কেউ জানতেও পায় না। গোপন সব স্বপ্ন ছিল আমার। আজও আমার স্বপ্ন শেষ হয়নি।
২
আমি লন্ডন শহর নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, প্যারিস নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, টোকিও নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, সুইজারল্যান্ড নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, কোলকাতা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, দার্জিলিং নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, তাজমহল নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, নায়াগ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আমি ঢাকা শহর নিয়েও স্বপ্ন দেখতাম, বিচিত্রা পত্রিকা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। গুলিস্তান, বাইতুল মোকাররম নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। বই পড়ে এইসব জায়গা চিনেছি। বই পড়ে স্বপ্ন তৈরী হয়েছিল। যদি বই না পড়তাম তাহলে এসব কিছুই ঘটত না জীবনে। বই আমার জীবনটাকে ওলোট পালট করে দিয়েছে। আমার জীবনে আজব সব ঘটনা ঘটেছে। যা ঘটার কথা ছিল না তাই ঘটেছে। আমার নিজের জীবনটাই একটা গল্প। অথচ আমি খুবই সাধারন জীবন যাপন করেছি, সাধারণভাবে বেড়ে উঠেছি। প্রতি পদে লড়াই করেছি। আমি শুধু টিকে থাকতে চেয়েছি। আমি কোনো মেধাবী কেউ না, কোনো যোগাযোগও নাই কারো সাথে। প্রকৃতির নিয়মেই অনেক কিছু ঘটে জীবনে। প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যায় সেসব।
নিউইয়র্ক সম্পর্কে এতো কথা বলার কারণ হচ্ছে এই শহরটাকে আমার অদ্ভুৎ ভাল লাগে। আমি কখনো কানাডায় আসব ভাবিনি। কানাডা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। নিউইয়র্কেই আমার বসতি হতে পারত। সে সম্ভবনা যথেষ্টই ছিল। নিউইয়র্কে আমার অনেক বন্ধু, স্বজন আছে। অনেক আপনজন আছে। আমার বইয়ের পাঠক আছে। নিউয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হয় আমি বাংলাদেশেই আছি। কি নাই এই শহরে! সব আছে। বাংলা পত্রিকা আছে, টেলিভিশন আছে, বইমেলা আছে, গ্রোসারি আছে, রেষ্টুরেন্ট আছে, ডাক্তার আছে, কবিরাজ আছে, উপন্যাসিক আছে, কবি আছে, সাংবাদিক আছে, শিক্ষক আছে, রাজনীতিবিদ আছে, মারামারি, কাইজ্যা আছে, লুঙ্গি আর ম্যাক্সি পড়ে রাস্তায় ঘোরার লোক আছে, পানের পিক ফেলার লোক আছে, ফুটপাথে ডাটা শাক বিক্রী করা আছে। ঢাকা শহরে যা নাই তা নিউইয়র্কে আছে। নিউইয়র্ক একটা মিনি বাংলাদেশ। দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাঙলার চর্চা এবং কর্মকান্ড নিউইয়র্কে হয়।
৩
নিউইয়র্কে আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আমার বন্ধু, বিচিত্রার সহকর্মী আকবর হায়দার কিরন। সুবেশি, চমৎকার ব্যাক্তিত্ব, মিষ্টি ব্যবহারের অধিকারী এই মানুষটিকে আশির দশক থেকে চিনি। সে সময় দৈনিক বাংলার করিডর দিয়ে স্যুট টাই পড়ে হেঁটে যেতেন। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম তাঁকে। বিচিত্রার কূটনৈতিক প্রতিনিধি ছিলেন। তার টানেও আমি নিউইয়র্ক যাই। তার আতিথ্য গ্রহণ করি। দেশ থেকে যে সব সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব, লেখক বা সাংবাদিক আসেন সবার সাথে তার রয়েছে সখ্যতা। ১৯৯৩ সালে আমেরিকা আসেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে তিনি কখনোই তার মূল কর্মকান্ড সাংবাদিকতা থেকে বিচ্যুত হননি। বর্তমানে ভয়েস অব আমেরিকার সাথে কাজ করছেন। এছাড়া নিউইয়র্ক বাংলা ডট কমের সম্পাদক এবং বাংলা টিভি নিউইয়র্কের পরিচালক। সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা এবং সাপ্তাহিক২০০০ এর আমেরিকা প্রতনিধি ছিলেন প্রথম থেকেই। যে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলের পুরোধা ব্যাক্তি কিরন।
কমিউনিটির মানুষদের খুবই প্রিয় একজন। অজাতশত্রু একেই বলে। আপাতঃ নিঃসঙ্গ, জেদি এবং অভিমানি এই মানুষটিকে খুব কাছ থেকে না দেখলে চেনা যাবে না। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, ঘনিষ্ট হয়েছেন তারাই তার মনের কোমল দিকটি জানেন। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের জন্য করার একটা তাগিদ সবসময় তার মধ্যে রয়েছে। সবসময় সত্যের পক্ষে সোচ্চার এবং ন্যায়ের পক্ষে প্রদিবাদী এই মানুষটিকে আমার অনেক পছন্দ।
টরন্টো ১৪ জুলাই ২০২২