NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, রবিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৫ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ব্রেকিং নিউজ
জব্বারের বলীখেলায় আবারও চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার ‘বাঘা’ শরীফ Bangladesh reaffirms commitment to fully Implement the CHT Peace Accord Kashmir Violence Conflict can be Solved Diplomatically or Needs a Retaliation Plan Against Pakistan ব্রেন স্ট্রোক পরবর্তী সময়ে সেরে ওঠার যুগান্তকারী ওষুধ আবিষ্কার নিউইয়র্কে প্রবাসীদের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মত  বিনিময় নিজেকে রাজা-বাদশাহ ভাবছেন ট্রাম্প! ‘দাগি’ দেখতে কয়েদির বেশে সিনেমা হলে শতাধিক নিশো ভক্ত Attorney General James Wins Case Against Google for Monopolies in Digital Advertising নিউইয়র্কে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংবাদ সম্মেলন নানা অভিযোগ উত্থাপন : বাংলাদেশ রেমিট্যান্স মেলা  বয়কটের আহবান নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় পুলিশের গুলিতে মানসিকভাবে অসুস্থ  এক ব্যক্তির মৃত্যু
Logo
logo

কতিপয় এলিট শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পসমালোচকের অশ্লীল আক্রমনের শিকার একজন এস এম সুলতান


লুৎফর রহমান রিটন প্রকাশিত:  ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:১৪ এএম

কতিপয় এলিট শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পসমালোচকের অশ্লীল আক্রমনের শিকার একজন এস এম সুলতান

 

লুৎফর রহমান রিটন

চব্বিশ বছর আগে, ১৯৯৮ সালে বেড়াতে গিয়েছিলাম জার্মানিতে। সেবার ফ্রাঙ্কফুর্ট, কোলন, বার্লিন, ডুসেলডর্ফ-এর মতো জাঁকজমকপূর্ণ শহর ছাড়াও কাসেল নামের মফস্বলগন্ধী একটা স্নিগ্ধ সাবার্ব অঞ্চলেও থেকেছিলাম কয়েকটা দিন। কাসেলের একটা পুরনো ধাঁচের বাড়ির চিলেকোঠায় আমি থাকতাম। সেখানে, আমার বিছানা লাগোয়া একটা বুকশেলফে বেশকিছু বই ছিলো থরে থরে সাজানো। কিন্তু বইগুলো পড়ার কোনো সুযোগ ছিলো না আমার। কারণ বইগুলো ছিলো জার্মান ভাষায় রচিত। এক বিকেলে মনে হলো পড়তে না পারি, দেখাও তো যায়! বই নেড়েচেড়ে দেখার মধ্যেও তো আনন্দ আছে।

সেই আনন্দটা পাবার জন্যে শান্ত নিঝুম এক বিকেলে এই বই সেই বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাতে উঠে এলো চিত্রকলা বিষয়ক একটা বই। পৃথিবীর নানা দেশের জগতবিখ্যাত আর্টিস্টদের শিল্পকর্ম নিয়েই এই সংকলন। সংকলনটিতে পৃথিবীবিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে আলাদা আলাদা আর্টিকল আছে। পড়তে পারছি না এক বর্ণও কিন্তু চিনতে পারছি শিল্পীদের। পিকাসো, ভ্যান গগ, পল গগাঁ, রাফায়েল, মাতিস, দালি, মনে, মিরো কিংবা সেজানের বিখ্যাত ছবিগুলোর অধিকাংশই আমার পরিচিত ছিলো। আরো কয়েকজন শিল্পীর শিল্পকর্মও ছিলো সেই সংকলনে যাঁদের আমি চিনতে পারিনি।

খুব আগ্রহ নিয়ে আমি পাতা উল্টাচ্ছিলাম আর পেইন্টিংসগুলো দেখছিলাম। সংকলনটির শেষ অংশে একটি পাতায় এসে চোখ আমার আটকে গেলো। আরে! এ যে দেখছি আমাদের এস এম সুলতানের ছবি! কী এক অদ্ভুত প্রসন্নতায় ভরে উঠলো কাসেলের নিঝুম সেই বিকেলটা!

সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে তাঁর আঁকা দুইটা ছবি। আছে সেই বিখ্যাত ছবিটাও, একজন পেশীবহুল পুরুষ তাঁর দু'হাতের মুঠোয় ধরে রাখা বৃক্ষ বা শষ্যের চারা রোপন করছেন মাটিতে। এই প্রিমেটিভ মনুষ্য চরিত্রের সঙ্গে আদম চরিত্রের মিল খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ।

ছবির উপরিভাগে পরিপুষ্ট দেহের দু'টি নারীচরিত্র,আকাশে ভাসমান। উড়ন্ত।

০২

সুলতানের ছবিতে উঠে আসা খুব সাধারণ মামুলি অনামা এই মানুষগুলোর শক্তি সাহস মেধা আর শ্রমেই পত্রপল্লবে ফুলে ফসলে ভরে উঠেছে আমাদের পৃথিবীটা। সমুখে এগিয়ে গেছে মানব সভ্যতা। ফসল ফলানো সেই অনামা মানুষদের শ্রমে ঘামে গড়ে ওঠা নিসর্গেরই কৃতি ও কৃতজ্ঞ সন্তান আমাদের এস এম সুলতান।

পুরুষের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সুলতান।

একই মৃত্তিকার সন্তান নারী ও পুরুষ। সেই নারীকে পুরুষের সমান্তরাল অবস্থানে উপস্থাপন করেছেন সুলতান।

নারীর চিরকালের নরম তুলতুলে, শক্তিতে দুর্বল ও ভীতু চরিত্রটাকে অস্বীকার করেছেন সুলতান।

পুরুষের মতোই কিছুটা পেশীবহুল এবং পরিপুষ্ট দৈহিক গড়ন সুলতানের নারী চরিত্রগুলোর।

সুলতানের দৃষ্টিতে ও সৃষ্টিতে মানুষের আদি ভূমিতে তাঁদের অবদান সমান।

কৃষি ব্যবস্থায় তাঁদের অবদান সমান।

শস্য উৎপাদনে তাঁদের অবদান সমান।

এমন কি সুলতানের শিশুরাও পেশীসদৃশ্য পরিপুষ্ট ইমেজ নিয়েই আবির্ভূত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুলতানের ক্যানভাসে। ব্যাপারটা আপাত অসম্ভব ও অবাস্তব চিন্তা মনে হলেও প্রতীকি অর্থে তা বেমানান নয়। শিশুর ভেতরের শক্তিকে তিনি চিহ্নিত বা চিত্রিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন ক্যানভাসে।

সুলতান যে প্রকৃত অর্থেই একজন শিশুপ্রেমী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে 'শিশুস্বর্গ' নামে বিশাল এক বজরা বা নৌকায় তাঁর উন্মুক্ত উদার প্রকৃতিসম্পৃক্ত একটি শিক্ষালয় বা পাঠাশালা নির্মাণের পরিকল্পনা থেকেই। তিনি চেয়েছিলেন শিশুরা তাঁদের নিজস্ব ক্ষমতা ও শক্তি দিয়ে প্রাণ-প্রকৃতির সকল সদস্যদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করুক। তাদের চিনুক জানুক ভালোবাসুক।

তারা ছবি আঁকুক। নৃত্য-গীতের অংশী হোক। সৃষ্টিশীলতায় মশগুল হোক। এবং এভাবেই গড়ে উঠুক একটি শিশুস্বর্গ।

সুলতান বেড়ালপ্রেমী ছিলেন। প্রচুর বেড়াল ছিলো তাঁর। ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হতো সুলতানকে। তিনি আহার করার সময় ওরাও সঙ্গী হতো তাঁর। ক্যানভাসে ছবি আঁকার সময় ওরা ঘোরাঘুরি করতো সুলতানের আশপাশে। শুধু বেড়াল নয়, কুকুর শেয়াল বেজিও পুষতেন সুলতান। সাপ পুষতেন। পাখি ভালোবাসতেন। টিয়া এবং প্যাঁচাও ছিলো তাঁর পরিবারের সদস্য। ছিলো একটা কাঠবেড়ালী এবং একটা বন মোরগও।

প্রকৃতির এইসব সদস্যদের সঙ্গে তাঁর মৈত্রীর বন্ধনটি ছিলো অকৃত্রিম। ওদের সঙ্গে মিলেমিশেই নড়াইলের নিভৃত গ্রামে তিনি নিজস্ব সংসার পেতেছিলেন সুলতান, যা প্রচলিত ধারণার স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সংসার ছিলো না।

০৩

বাংলাদেশে সুলতানের প্রথম একক শিল্প প্রদর্শনীটি উদবোধন করা হয়েছিলো ১৯৭৬ সালের ০৫ সেপ্টেম্বর, শিল্পকলা একাডেমিতে। জেনেছিলাম, সুলতান এখানেই, গ্যালারির পাশের উন্মুক্ত ফ্লোরেই থেকেছেন কিছুদিন। ছবি এঁকেছেন প্রদর্শনীর জন্যে।

পত্রিকায় সেই সংবাদ পাঠ করে সুলতানের প্রদর্শনী ও সুলতানকে দেখতে অনেকের মতো কিশোর আমিও ছুটে গিয়েছিলাম শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলায় তাঁকে দেখে নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা একজন ইন্ট্রোভার্ট মানুষই মনে হয়েছে। চারপাশের সমস্ত উৎসুক মানুষের ভিড়কে যিনি তোয়াক্কা না করেও নিজের কাজে মশগুল থাকতে পারেন।

এই প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করেই মূলত প্রথম ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিলো সুলতান বিষয়ে। এরপর এলিট সোসাইটির চোখ পড়ে সুলতানের দিকে। মনোযোগ কাড়েন তিনি সাধারণ মানুষেরও।

এরপর চারুকলা ইন্সটিটিউটেও তাঁকে দেখেছিলাম।

গলায় অনেকগুলো মালা ঝোলানো মেজেন্টা রঙের অদ্ভুত পোশাকে সজ্জিত লিকলিকে স্বাস্থের দীর্ঘদেহী সুলতানকে দেখে যাত্রা দলের কোনো চরিত্র বলে ভ্রম হয়েছিলো আমার।

তাঁকে দেখেছি মুগ্ধ নয়নে।

দেখেছি, তাঁকে ঘিরে রেখেছেন আমাদের বিখ্যাত সব মানুষজন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে অদ্ভুত একটা নির্লিপ্ততা। রাজধানীর শিল্পসাহিত্যের এলিট মানুষদের সঙ্গে তাঁকে ঠিক মানাচ্ছিলো না। শারীরিক উচ্চতায় পোশাকে আশাকে হাঁটাচলায় সব কিছুতেই সুলতানকে মনে হচ্ছিলো একজন আউটসাইডার।

অরুণ চক্রবর্তীর কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো ছিলেন তিনি সেদিন--

'তু লাল পাহাড়ের দেশে যা

রাঙামাটির দেশে যা

হেথায় তোকে মানাইছে না রে

এক্কেবারে মানাইছে না রে'......।

০৪

পৃথিবীতে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পভাবনা ও শিল্প্রুচিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। সুলতান ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন।

কঙ্ক্রিটের বা ইটপাথরের শহরে থাকতে চাইতেন না বলেই জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন নড়াইলের জন্মগ্রামের প্রকৃতি ও সহজ সরল জনমানুষের নিকট সান্নিধ্যে। নদী বৃক্ষ মানুষ পাখি সাপ ইত্যাদি প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে নিজের জীবনটাকে শেয়ার করতে চেয়েছেন বলেই শহরের কোলাহল ও ধূর্ততা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এবং দীর্ঘদিনব্যাপি তিনি যাপন করেছেন অপরূপ একটা মানবজীবন--যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের...।

০৫

সুলতানকে অবলীলায় বিক্রিও করেছেন এনজিও ব্যবসায় পারদর্শী কেউ কেউ।

শাহবাগের আজিজ মার্কেটের কোলাহলমুখর ঘিঞ্জি জনবহুল নিচতলায় একটা কক্ষ বা দোকান ছিলো। দোকানটির সাইনবোর্ডে উৎকীর্ণ ছিলো 'এস এম সুলতান পাঠশালা'।

তাঁর নামে বৈদেশিক ফান্ড পাওয়া যেতো নিশ্চয়ই। নইলে বস্তিতে থাকা দুস্থ অসহায় বালক বালিকাদের শিক্ষা ও এক্টিভিটির নামে এইরকম বিরুদ্ধ পরিবেশে ছোট্ট কামরায় সুলতান নামাঙ্কিত ইশকুল গড়ে উঠবে কেনো? কাটাবনের মার্কেটেও দেখেছি সুলতানের নামে স্কুল।

রাজধানীর চালাক-চতুর মানুষেরা নানান মতলবে সুলতানকে ব্যবহার করতে চাইতেন নানান তরিকায়। সুলতান নিশ্চয়ই সেটা বুঝতেনও। বোহেমিয়ান স্বভাবের ভাবুক সুলতান বুদ্ধিমানদের নানা আয়োজনে শামিল হলেও কখনো কখনো পলায়নও করতেন সেইসব প্রেক্ষাপট থেকে। এরকম একাধিক নজির তিনি স্থাপন করেছেন। আমরা স্মরণে আনতে পারি দু'একটি ঘটনা।

সিলেটের শ্রীমঙ্গলের কাছে ভানুগাছি মনিপুরি পাড়ায় সুলতানকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। উদ্দেশ্য ওখানে অনুষ্ঠিতব্য মনিপুরি নৃগোষ্ঠীর রাস মেলাটি সুলতানকে দেখাবেন। সুলতান ছবি আঁকবেন রাস উৎসবের।

সেই পরিকল্পনায় বাংলা একাডেমিকেও যুক্ত করেছিলেন কয়েকজন সুলতানপ্রেমী লেখক-কর্মকর্তা। বাংলা একাডেমির উদ্যোগ ও বাজেটে রঙ তুলি ক্যানভাস কেনা হয়েছিলো সুলতানের জন্যে। শ্রীমঙ্গল চা-বাগানের শ্রমিকদের কিছু ছবি সুলতান এঁকেছিলেন সেবার। ১৯৭৮ সালের ১১ নভেম্বর রাস উৎসবটি হবার কথা ছিলো।

কিন্তু রাস উৎসবের আগের দিন গভীর রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে সকলের অগোচরে রঙ তুলি ক্যানভাস নিজের জামাকাপড় সবকিছু ফেলে রেখে সুলতান পালিয়ে গিয়েছিলেন সেই ভানুগাছি অঞ্চল থেকে।

০৬

জন্মগত জাতশিল্পী এবং জাত বোহেমিয়ান সুলতানকে বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীর সঙ্গে মেলানো যায় না।

এভারেজ বাঙালির শারীরিক উচ্চতার চাইতে তিনি দীর্ঘ ছিলেন। সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট শীর্ণ দেহী সুলতানের শারীরিক গঠনের সঙ্গে তাঁর ক্যানভাসের হিউম্যান ফিগারের কোনো মিল নেই। বরং বিরোধ আছে। বাংলার কৃষকরা খেতে পায় না। কিন্তু সুলতানের কৃষকরা পেশীবহুল, জান্তব দানব কিংবা অতিমানব রূপে আভির্ভূত। সুলতানের কাল্পনিক এই কৃষকদের অস্তিত্ব এই পৃথিবীর কোথাও দৃশ্যমান নয়। মিথ ও মিথোলজির নানা চরিত্র ইউরোপিয়ান শিল্পীদের ক্যানভাসে আমরা মূর্ত হতে দেখেছি।

মিথ-মিথোলজির মিথস্ক্রিয়ায় সুলতানের ক্যানভাসেও তার অনুরণন। প্রতিধ্বনী। এবং দৃষ্টিভঙ্গিজনিত এরকম প্রেক্ষাপটের কারণেই সুলতানের পরিধি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্রগামী। পৃথিবীবিখ্যাত শিল্পীদের পাশেই তাঁর অবস্থান। জার্মানীর একটি মফস্বল শহরের একটি সাধারণ পরিবারের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে থাকা জার্মান ভাষায় রচিত গ্রন্থেও তাঁর সসম্মান উপস্থিতি।

সুলতানের অনন্যতা এখানেই।

০৭

আমার জন্যে একান্ত সুখের এবং স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, কোনো তথাকথিত শিল্পবোদ্ধা বা শিল্পসমালোচকের প্রেসক্রিপশন অনুসারে আমি কখনোই সাহিত্যপাঠ কিংবা শিল্প অবলোকন করি না। করলে কতো রকমের অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যে আক্রান্ত হতাম!

আমাদের কিছু শিল্পী ও শিল্পসমালোচক সুলতানের ছবিতে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদায় না রেখে দ্বিতীয় সারিতে রাখার অভিযোগ করেন। সুলতানের ক্যানভাসে তাঁরা নারী চরিত্রকে ফোকাস পয়েন্টে রাখা হয়নি বা পুরুষের সমান মর্যাদায় গ্লোরিফাই করা হয়নি বলে আফসোস জারি রাখেন। এইটুকু মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যখন কেউ--সুলতান তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজরা ছিলেন কি ছিলেন না-র তত্ত্বতালাশের নামে অশ্লীল ও কুৎসিত রগড় চর্চায় মত্ত হন তখন সেই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলোর শিক্ষা-রুচি ও সংস্কৃতি নিয়ে সন্দেহ জাগে। সভ্যতার এই চরম বিকাশকালের চূড়ায় বসেও তাঁরা অন্ধকারাচ্ছন্ন, দৃষ্টিহীন এবং অনাধুনিক। শিল্পী হবার কিংবা শিল্পসমালোচক হবার যোগ্যতা আদৌ তাঁরা রাখেন কি না সে প্রশ্ন তখন সামনে এসে দাঁড়ায়।

আধুনিক পৃথিবীতে একজন মানুষ কোন্‌ জাতির কোন্‌ বর্ণের কোন্‌ ধর্মের কিংবা কোন্‌ লিঙ্গের সেটা ধর্তব্যে আনা হয় না। এমনকি মানুষটা সমকামী কিনা কিংবা উভকামী কিনা সেটাও বিবেচ্য হয় না। শিল্পমান কিংবা মেধা নির্ণয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সেক্সুয়্যালিটি কেনো গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে!

কে স্ট্রেইট আর কে গে বা লেসবিয়ান বা সমকামী সেটা বিবেচনায় আনে শুধু অর্বাচীনরাই। বেদনা ও আক্ষেপের বিষয়, সুলতান প্রশ্নে এইসব শিল্পঅর্বাচীনরাও আমাদের এলিট সোসাইটিতে সসম্মানে বহাল।

প্রচলিত শিল্পভাবনাকে অস্বীকার করে নতুন দিগন্তের অনুসন্ধান ও নতুন ভাবনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন আঙ্গিক ও বার্তা নিয়ে এসেছিলেন সুলতান। সেই কারণেই আর কারো সঙ্গেই মেলেনি তাঁর চিন্তা। তাঁর অনুসন্ধান। তাঁর স্বপ্ন। এবং তাঁর বাস্তবতা।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সুলতানের উচ্চতার সামনে এইসব তথাকথিত শিল্পবোদ্ধা সমালোচকরা নিতান্তই খুদে। দিন যতো যাচ্ছে সুলতান ততোই দীপ্যমান হয়ে উঠছেন।

দিন যতো যাবে সুলতান ততোই দীপ্যমান হয়ে উঠবেন।

অটোয়া ০৮ জুলাই ২০২২

[ ক্যাপশন/ নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে মাছিমদিয়া গ্রামে নিজের বাড়িতে বেড়ালবন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন শিল্পী এস এম সুলতান। অসাধারণ এই ছবিটির আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সময়কাল ডিসেম্বর ১৯৭৯। ]