NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, সোমবার, এপ্রিল ২৮, ২০২৫ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

আবার ঢাকায় শৈশব-কৈশোরের ও ছাত্র জীবনের বন্ধুত্ব -- হাসান ফেরদৌস


খবর   প্রকাশিত:  ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১২:০৮ এএম

আবার ঢাকায় শৈশব-কৈশোরের ও ছাত্র জীবনের বন্ধুত্ব -- হাসান ফেরদৌস

 

আমাদের অধিকাংশ সম্পর্কই ট্রানজ্যাকশনাল. তাতে লেন -দেনের হিসাব-নিকাশ থাকে . এক ব্যতিক্রম শৈশব-কৈশোরের ও ছাত্র জীবনের বন্ধুত্ব. আফসান চৌধুরী ও ওয়াসি আহমদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ঠিক সেই রকম . এই বন্ধত্বের বয়স প্রায় ৫৫ বছর . আমরা তিনজনই একসঙ্গে বুড়ো হচ্ছি.ওয়াসির সঙ্গে গত বছর নিউইয়র্কে দেখা হয়েছিল. আফসানের সঙ্গে দীর্ঘ দিন দেখা নেই. এবার ঢাকায় ওয়াসির বাসায় দেখা . কত স্মৃতি, কত কথার লড়াই, সব এক লহমায় এসে ভীড় করে.

আমাদের বন্ধুত্ব কিছুটা 'ইম্প্রোবাবল'. আফসান-ওয়াসি দুজনেই বিস্তর লম্বা, আমি খর্বকায়. ওয়াসি কার্যত নীরব, আফসান বাক্যবহুল , তদুপরি ইংরেজি বোলচালে অভ্যস্ত. আমরা সবাই ঢাকা কলেজে আর্টসের ছাত্র . ফোর্থ সাবজেক্ট ছিল লজিক. শুনেছি কলেজে এদের পাশে আমি দাঁড়ালে সবাই সদ্য শেখা লজিকের পাঠ ধার করে বলত 'কম্পেয়ার এন্ড কনট্রাস্ট '.

কলেজে ওঠার প্ৰথম সপ্তাহেই উভয়ের সঙ্গে পরিচয়. যদ্দুর মনে পরে, ওয়াসি ক্যান্টিনে সিঙ্গারা খাচ্ছিল. আমি লোভাতুর চোখে তাকিয়েছি দেখে বলল, খাবে, নাও একটা. (এই ঘটনা অবশ্য ওয়াসি না হয়ে আমাদের আরেক বন্ধু তৌফিক খান মজলিশকে নিয়েও হতে পারে).

আফসানের সাথে বন্ধুত্বের শুরু ওর হাতে হাসান হাফিজুর রহমানের একটি কবিতার বই দেখে. সবার চেয়ে ভিন্ন এই ছেলেটি, যার মুখে ইংরেজি বোলচাল, সেই ছেলে বাংলা কবিতার বই নিয়ে কী করছে? বিস্ময় থেকে আগ্রহ, সেখান থেকে বন্ধুত্ব.

আমাদের তিনজনেরই একটা 'কমন' জায়গা ছিল সাহিত্য. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার সপ্তাহে একবার ক্লাস শেষে আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে বসতেন, সাহিত্যের ক্লাস. বন্ধুত্ব ঘন হবার সেটি একটি কারণ. তবে যে জিনিসটি আমাদের এক সুঁতোয় গাঁথল সেটি হল পূর্বপত্র এই নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা. কার প্রস্তাব মনে নেই, কে নাম ঠিক করেছিল তাও জানিনা. কলেজে ও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পত্রিকাই হয়ে উঠল আমাদের সিগনেচার. সম্ভবত অন্যদের চেয়ে নিজেদের শুধু স্বতন্ত্র নয়, অধিক বুদ্ধিমান ভাবতে শুরু করেছিলাম. বয়সটাই তখন সেই রকম ছিল: উদ্ধত , বেয়াদব. মনে আছে কমুনিস্ট পার্টির সাহিত্য পত্রিকা গণসাহিত্য প্রথম প্রকাশ হলে আফসান পূর্বপত্রে তাকে 'শামসুর রাহমান এন্ড গংদের' পত্রিকা হিসেবে বর্ণনা করেছিল. পরে দৈনিক বাংলা অফিসে রাহমান ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি আফসানকে বের করে দিয়েছিলেন. (এই গল্পের সত্যতার দায় -দায়িত্ব একা আফসানের, তার কাছ থেকে শোনা.) মনে আছে রাহমান ভাইয়ের স্বকণ্ঠে কবিতা কোলকাতা থেকে রেকর্ড হয়ে বেরুলে আমি পূর্বপত্রে কিঞ্চিৎ বিদ্রুপ করে লিখেছিলাম. সেজন্য বড়ভাইদের তিরস্কারের মুখে পড়েছিলাম .

এই পূর্বপত্রের জন্য আমি নিজে একবার হাসান আজিজুল হককে কয়েকটি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম. এমন সময়ের কথা বলছি যখন বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমাদের উপেক্ষা পর্বত-প্রমাণ. ঠিক সেই সময় পড়ি আত্মজা ও করবী গাছ. একদম তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম. এমন ভাষায় গল্প লেখা সম্ভব! সেই চিঠিতে জানার চেয়ে জানানোর আগ্রহই ছিল বেশি. ভাবিনি জবাব পাব. কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরে ঠিক লম্বা জবাব এসে হাজির. পরে মফিদুল হক ভাইয়ের কাছে শুনেছি হাসান ভাই মৃদু হেসে প্রশ্ন করেছিলেন , বাচ্চা ছেলে নিশ্চয়? সেই চিঠির সূত্রে যে সম্পর্কের শুরু তা হাসান ভাইয়ের শেষ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল.

সাহিত্য নিয়ে আমার বা আফসানের যত উৎসাহ থাকুক না কেন, প্রথম বই কিন্তু বেরিয়েছিল ওয়াসির. কৃশকায় একটি গল্পের সংকলন , আফসান তার প্রকাশক. আমার মনে হয়্না ওয়াসির সেই বইয়ের কথা তেমন একটা মনে আছে. দরকারও নেই. মনে রাখার মত ডজন খানেক বই তার রয়েছে.

পূর্বপত্র ঘিরে স্মৃতির কথা যখন উঠল তখন আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে. ১৯৭৩ এর অগাস্টে আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাই মস্কো. ততদিনে পূর্বপত্র পুরোপুরি আফসানের নিয়ন্ত্রণে. জুন বা জুলাই মাসে সে ঠিক করল পূর্বপত্র সাহিত্য পুরস্কার দেবে তিনজনকে. উপন্যাস হুমায়ুন আহমদ, কবিতা নির্মলেন্দু গুণ এবং প্রবন্ধে আবদুল মান্নান সৈয়দ. মধুর ক্যান্টিনের সামনে রীতিমত সাহিত্য সভা করে পুরস্কার দেওয়া হবে. আমার ওপর দায়িত্ব বর্তাল এদের তিনজনকে নিয়ে পরিচিতি মূলক প্রবন্ধ লেখার. প্রবন্ধের নাম ছিল 'এই ত্রয়ী জয়ীকে', কি লিখেছিলাম এখন আর মনে নেই, শুধু মনে আছে মান্নান সৈয়দকে অহেতুক নির্মম ভাবে আক্রমণ করেছিলাম . সে লেখার কথা মনে রাখার প্রয়োজন দেখিনি, যদিও তখন নিজেকে বেশ পন্ডিত পন্ডিত মনে হয়েছিল,

২৫ বছর পর, আমি তখন নিউইয়র্কে, আকস্মিক ভাবে চোখে পড়ল ঢাকার এক পত্রিকায় মান্নান সৈয়দের স্মৃতিচারণ, আমার সমালোচকবৃন্দ. সেখানে তিনি সেই লেখার প্রসঙ্গ তুলেছেন. জানিয়েছেন আমি নাকি এমন রেগেছিলাম যে আমার অনেক কথাই তিনি বোঝেননি. এরপর টিপ্পনি হিসাবে যোগ করেছেন, সেই ছেলে (অর্থাৎ আমি) টাকার লালচে আমেরিকায় চলে গেছি, আর হাতের চুলকানি মেটাতে মাঝেমধ্যে লিখে থাকি. সে লেখা পড়ে ঢাকা থেকে সাজ্জাদ শরীফের ফোন, হাসান ভাই, এলেখা আপনাকে নিয়ে?

আহারে, তিনি এত দুঃখ পেয়েছেন যে তা ২৫ বছর বুকের মধ্যে পুষে রেখেছেন! জানা থাকলে অবশ্যি ক্ষমা চেয়ে নিতাম. তিনি হয়ত জানতেন না আমি তাঁর লেখার ভক্ত পাঠক. রাশিয়া থেকে চিঠি লিখে মফিদুল ভাইয়ের কাছ থেকে 'শুদ্ধতম কবি' সংগ্রহ করেছিলাম.

ওয়াসির বাসায় সেদিন রাতে কথা আফসানই বলছিল. ওয়াসি হোষ্টের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত . আমি তাঁর কথা শুনছিলাম কি শুনছিলাম না. মনের মধ্যে নানা গল্প ভীড় করছিল. যেন কালেইডস্কপ, বায়োস্কোপের বাক্সের ঘুলঘুলি দিয়ে একের পর দৃশ্যচিত্র দৌড়ে যাচ্ছিল. তা দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে . অদৃশ্য রুমাল দিয়ে চোখ মুছি .