গত ১৯শে জুন ২০২৩ সোমবার আয়ারল্যান্ডের লিমরিক সিটি ও কাউন্টি কাউন্সিলের নির্বাচনে জনাব আজাদ তালুকদার, মেয়র বা কাহার্লক নির্বাচিত হন। মোট কুড়ি জন কাউন্সিলরের ভোট মধ্যে তের জনের সমর্থনে তিনি মেয়ের বা নগরাধ্যেক্ষের পদে আসীন হলেন। আজ পর্যন্ত ক্যাথলিক অধ্যুষিত দক্ষিন আয়ারল্যান্ড বা রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডে কোনো বিদেশি বা অভিবাসী সম্প্রদায়ের কেউ মেয়রের মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেননি। জনাব সাজেদুল চৌধুরী রুবেল এক প্রতিবেদনে জানান, ‘জনাব তালুকদার দেশটির শক্তিশালী ও ঐতিহ্যবাহী এবং কোয়ালিশন সরকারে যে রাজনৈতিক দলের অংশীদারিত্ব রয়েছে তারা হলেন Fianna Fail। বা ফিনাফল। জনাব আজাদ তালুকদার তাদের মনোনয়ন পেয়ে ২০১৯ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে লিমেরিক কাউন্টি কাউন্সিলে প্রথম একজন বাংলাদেশি কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন’। আইরিশ নোটিস বোর্ড জানান, ‘জনাব আজাদ তালুকদার অভিবাসী হয়েও গত দুইযুগ আগে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ফিনেফল পার্টির কর্মী হয়ে কাজ শুরু করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ২০১৯ সালে তিনি সরাসরি ভোটে ফিনেফলের মনোনয়ন পেয়ে প্রথম কাউন্টি লিমেরিকের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তখন নির্বাচিত মোট ৪০জন কাউন্সিলরের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র অভিবাসী কাউন্সিলর। এরপর তিনি কাউন্সিলদের ভোটে ২০২০ সালে লিমেরিক শহরের ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালে মেয়র পদের জন্যে তিনি Fianna Fail দলের বিপুল সমর্থনে মেয়র বা কাহার্লক হিসাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করার মনোনয়ন অর্জন করেন। তিনি একজন অবিচল সমাজ সেবী। গাজীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আজাদ তালুকদারের জন্ম। জীবিকার তাগিদে ২০০১ সালে তিনি এ দেশে এসেছিলেন। জীবনের অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে আজ একজন বরেণ্য মানুষ।
এবার তিনি ১৯শে জুন ২০২৩ সালে, পূর্ণ মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে লিমেরিক শহর ও লিমেরিক কাউন্টির নগরাধ্যক্ষ হলেন।
এই সংবাদ আয়ারল্যান্ডে বসবাসকারী অভিবাসীদের কাছে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ দর্শন স্বরূপ প্রতীয়মান হচ্ছে। তার কারণ, আয়ারল্যান্ডের বা লিমেরিকের হাজার বছরের ইতিহাস। চারদিকে জলধিতে ঘেরা কবিদের আখ্যায়িত ‘Emerald Isle’ বা ‘পান্না দ্বীপ’ আয়ারল্যান্ডে, লিমেরিক নগরী মধ্য পশ্চিমে, শ্যানন নদীর মোহনায় অবস্থিত। লিমেরিকের জনসংখ্যা এক শত হাজারের কম। আয়ারল্যান্ডের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি, ১১৯৭ সালে শহর থেকে নগর বা সিটি হিসাবে সনদ অর্জন করে। আমেরিকার জন এফ কেনেডি পরিবার কাউন্টি লিমেরিক থেকে উদ্ভব হয়েছে। আমেরিকায় লিমেরিক নামে বেশ কিছু জায়গাও রয়েছে। ভাইকিংরা ৮১২ খ্রিস্টাব্দের দিকে বর্তমানের লিমেরিক নামের নগরে, এক দেয়াল ঘেরা শহর স্থাপন করেছিল। তারা ছিল উঁচুদরের ব্যবসায়ী এবং কারিগর যাদের বানিজ্য বিস্তারের অছিলায় লিমেরিকের সংযোগ হয়েছিল সারা ইউরোপ জুড়ে। পরবর্তীতে পরিণত হয় জর্জিয়ান এক শহরে কাজেই, সে ঐতিহাসিক সূত্র ধরে আধুনিক লিমেরিক প্রযুক্তি, বানিজ্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে উন্নীত হয়ে সারা ইউরোপে সমাদৃত। আর সেসব ইতিহাসে প্রভাবিত হয়ে লিমেরিকে ল্যাটিন নীতিবাক্যের একটি সম্পর্ক যুক্ত হয়েছে। প্রায় আট শত বছর ব্রিটিশ প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্ম ভিত্তিক বিভেদি শাসন যা ‘Penal Law’ বলে পরিচিত ছিল, এসব থেকে মুক্ত হবার পর ক্যাথলিক অধ্যুষিত দক্ষিন আয়ারল্যান্ড বা রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড এক সময়কার দারিদ্র্যতা, বেকারত্বের আভিশাপ ও ধর্ম বিভেদি মনোভাব চিরতরে মুছে দিয়ে, ২০০০ সালের পর থেকে এক সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। তার মধ্যে লিমেরিক নগর বা সিটি একটি তুলনাহীন উদাহরণ।
উল্লেখ্য একসময় এই নগরে বিশাল ক্যাথলিক জনতা- বৃহৎ আলু দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নিজেদের তথৈবচ অবস্থার উন্নতির জন্যে সে কাল থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে নির্লিপ্ততা এবং নিজেদেরকে ক্যাথলিক আদর্শ প্রণোদিত সমাজে পরিণত হবার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৮১ সালে আমরা এখানে প্রথম পদার্পণ করি। লিমেরিকের একমাত্র বাঙালি পরিবার! বেশির ভাগ মানুষ আমাদের কাছে বন্ধু সুলভ এবং দরদী মনে হয়েছিল। তবে, অতি সাধারণ মানুষের কাছে আমরা কি ধর্মের তা নয় আমরা প্রটেষ্টেন্ট না ক্যাথলিক তাই ছিল প্রশ্ন। মনে হতো, দুনিয়াতে শুধু দুটোই ধর্ম রয়েছে। তাছাড়া, শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রভাব দারুণভাবে বিস্তারিত ছিল। ১৯৮৫ পর মহিলাদের পুরোপুরি সমানাধিকার আইন পাশ হয়। ২০০০ সাল থেকে বিদেশ থেকে বিভিন্ন কর্মস্থলে বিদেশীদের কাজ করার অনুমতি দেবার প্রথা আসে। সেই সময় থেকে ইউরোরীয়ান ইউনিয়নের নীতিমালায় দেশের আইনে পরিবর্তন দারুণভাবে পরিলক্ষিত হয়। আজ আয়ারল্যান্ড ইউরোপ শুধু নয় দুনিয়ার মাঝে একটি সচ্ছল ধনী দেশ। একটি মানবিক দেশ।