বহু বছর ধরে, কানাডা বিশ্বব্যাপী সেইসমস্ত মানুষের গণতান্ত্রিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে যারা শুধুমাত্র আংশিকভাবে ক্ষমতায়ন এবং নিম্নধারার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা ভোগ করে এসেছে। কানাডার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের পরে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ নিম্নগামী। Varieties of Democracy Project- এর অনুসন্ধান বলছে, গত দশক থেকে মাথাচাড়া দিয়েছে নির্বাচনী স্বৈরাচার। যার জেরে বেশ কয়েকটি দেশে যেখানে একসময় অর্থবহ নির্বাচন ছিল, সেখানে এখন কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বে দিচ্ছে স্বৈরাচারী সরকার। এর প্রতিক্রিয়ায়, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন 'গ্লোবাল সামিট ফর ডেমোক্রেসিস' গঠন করে গণতন্ত্রকে তার প্রধান ইস্যুতে পরিণত করেছেন। প্রথম ভার্চুয়াল সামিট ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তার ভার্চুয়াল ফলো-আপ সংঘটিত হয়েছিল। কানাডা দৃঢ়ভাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে সমর্থন করে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ঘোষণা করে। সরকার গণতন্ত্রের প্রচারে কানাডার পরিচিত ভূমিকাগুলিকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে। উদাহরণস্বরূপ, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাবের কাজ, ফ্রাঙ্কোফোন আফ্রিকায় ইলেকশনস কানাডার ভূমিকা এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবস্থাপনা। যারা নির্বাচনী জালিয়াতির সাথে জড়িত তাদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কার্যকর করার জন্য একটি নতুন নীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে কানাডার। মেরুকৃত, সহিংস এবং প্রশ্নবানে জর্জরিত নির্বাচনী ইতিহাস রয়েছে ১৭২ মিলিয়নের দেশ বাংলাদেশের। যে দেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন আসন্ন।
বাংলাদেশী অভিজাতদের ফোকাসে রেখে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সংঘটনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করতে আগ্রহী কানাডা। বাংলাদেশের ভাগ্য বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যদিও অনেক মানুষ এখনও দেশটিকে একটি দরিদ্র এবং সমস্যাপূর্ণ জায়গা হিসেবে দেখে। এর অর্থনীতি এখন ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনের সাথে সমভাবে বেড়েছে।জনপ্রতি এর জিএনআই ( Gross National Income ) ভারতের চেয়ে বেশি। এই সময় বাংলাদেশ যদি গণতন্ত্রের ভিত্তি থেকে নির্বাচনী স্বৈরাচারে চলে যায় তাহলে তা দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনবে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় রাজনৈতিক কর্তাদের এবং তাদের অনুসারীদের উপর বকলমে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। দলীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং একটি উন্নত ভোটার তালিকার পরিকাঠামো প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে। কানাডা অতীতে ব্যালট বাক্সে স্বচ্ছতা প্রদান করে একই কাজ করেছে। তবুও, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমেরিকা ২০২১ সালে বাংলাদেশের অভিজাত আধাসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের কিছু সদস্যের সফরের অনুমতি দেয়নি।
এছাড়াও, গ্লোবাল সামিট ফর ডেমোক্রেসিসের কোনোটিতেই বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটা বলা ন্যায়সঙ্গত যে, বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সরকারের গতিপ্রকৃতি দেখে আমেরিকা ধৈর্য হারাচ্ছে। ২৪ মে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেন, যে বাংলাদেশিরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করবেন তাদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হতে পারে। একজন নেতৃস্থানীয় বাংলাদেশী আমেরিকান আলী রিয়াজ, আটলান্টিক কাউন্সিলের জন্য এই নীতিটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘’নতুন এই নীতির আওতায় বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারীদের ভিসা নাকচ করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় "প্রতিবন্ধকতা" হিসেবে তাদের বিবেচিত করা হবে। ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণের প্রতি সহিংস ব্যবহার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা মিডিয়াকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা -এই বিষয়গুলি 'নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারী কাজ' হিসেবে গণ্য করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিমালার আওতায় যারা আসবেন তাদের মধ্যে থাকবেন- বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।'' ব্লিঙ্কেনের ঘোষণার পরের দিন, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে নীতিটি কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যই নয়, খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেকের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপির জন্যও প্রযোজ্য, যিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত। নীতিটি "ম্যাগনিটস্কি অ্যাক্ট" এর মতো নির্বাচনী হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেয় যা মিডিয়া দমন সহ মানব ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের জন্য সম্মিলিত নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে ব্যক্তিগত দায়িত্বের উপর ফোকাস করে।
এই নীতির অধীনে ভবিষ্যতে ভিসা প্রত্যাখ্যান করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা নির্ধারিত মানগুলি সম্ভবত আন্তর্জাতিক মান তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি আফ্রিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত আধা-বিচারিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে- যেমন একটি নির্বাচন গণতান্ত্রিক দেশগুলির দ্বারা বৈধ হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার জন্য যথেষ্ট অবাধ ও নিরপেক্ষ কিনা? কিন্তু এর বিচার কে করবে? কিভাবে করবে? গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের নীতি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। প্রকৃতপক্ষে, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলি দ্বারা ব্যবহৃত "অবাধ ও নিরপেক্ষ" বলতে কী বোঝায় তার বিভিন্ন সংজ্ঞাগুলি বিভ্রান্তিকর, মূলত অপর্যাপ্ত এবং কখনও প্রয়োগ করা হয় না। পণ্ডিত পিপা নরিস এবং সুসান হাইড 'Electoral Integrity' প্রকল্পে তাদের ত্রুটিগুলি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। আসলে আংশিকভাবে, কোন কার্যকর নিষেধাজ্ঞা না থাকায় সমস্যাটি তৈরি হয়েছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোভিজ, South Asia Perspectives - এ লিখেছেন:" অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক অংশীদারদের বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমর্থনে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের সময় এসেছে ।" কানাডা, এই বিষয়ে একটি মহাদেশীয় নীতির চাবিকাঠি প্রদান করে কারণ এটি অনেক সচ্ছল বাংলাদেশির আকর্ষণের কেন্দ্র। পাশাপাশি কানাডা একটি কৌশলগত গণতান্ত্রিক ভিসা নীতি গ্রহণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করতে আগ্রহী । উদাহরণস্বরূপ, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC) ভিসা নীতির বাস্তবায়ন, মানদণ্ড এবং সংকল্প, বিচার, আপিল এবং প্রয়োগের বিশদ বিবরণ হিসাবে কানাডিয়ান দক্ষতাকে তুলে ধরতে পারে। এইভাবে, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বার্তা পাঠাতে পারে: উত্তর আমেরিকা তাদের সম্পদ এবং পরিবারগুলির নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক ম্যানিপুলেটর এবং অলিগার্চদের হাতে তুলে দেবে না।
একটি "কৌশলগত গণতন্ত্র ভিসা" সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। তাই GAC-এর উচিত ওয়াশিংটনের সাথে আলোচনা করে দুই দেশ কীভাবে নীতিটি বাস্তবায়ন করতে পারে সেদিকে নজর দেয়া। এটি বাস্তবায়িত হলে তিনটি সুস্পষ্ট সুবিধা আছে : ১) এটি প্রয়োগের ফলে একটি মহাদেশীয় নীতি বাস্তবায়িত হবে এবং ন্যাটো, কমনওয়েলথ এবং লা ফ্রাঙ্কোফোনি অংশীদারদের বৃহত্তর গ্রহণে অনুঘটক ভূমিকা পালন করতে পারে। ২) এটি নির্বাচনী গণতন্ত্র এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে কানাডার পরিচিত শক্তিগুলিকে তুলে ধরে। ৩) কানাডা একটি দ্বিভাষিক, নাগরিক এবং সাধারণ আইন ব্যবস্থা, একটি সংসদীয় সংবিধানের মধ্যে বহুজাতিক দেশ হিসাবে তার মর্যাদাকে শক্তিশালী করবে। স্বার্থের কথা বাদ দিলে , বাংলাদেশের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং কানাডা সর্বদা বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। কানাডায় বাংলাদেশী প্রবাসীরা একটি উল্লেখযোগ্য এবং প্রাণবন্ত সম্প্রদায়। তাদের অবশ্যই সাহায্য করা উচিত। সূত্র : opencanada.org লেখক : ওয়েন লিপার্ট , নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিএইচডি) স্নাতক