NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, সোমবার, জুন ১৬, ২০২৫ | ২ আষাঢ় ১৪৩২
ব্রেকিং নিউজ
বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিতর্কিত তিন সংসদ নির্বাচনে জড়িতদের ভূমিকা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার " ইসরায়েল আন্তর্জাতিক পারমাণবিক স্থাপনা আইন ভঙ্গ করেছে এবং শীর্ষ ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে” ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক যুক্তরাষ্ট্রের ২০টি হলে শাকিব খানের ‘তান্ডব’র শুভ মুক্তি Iran Attack, a Foggy Peace and Truce Deal in Gaza - Dr Pamelia Riviere ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিনন্দিত লায়ন শাহ নেওয়াজ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাসহ ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল ভারতীয় বিধ্বস্ত উড়োজাহাজে কারও জীবিত থাকার সম্ভাবনা নেই বিয়ানীবাজারবাসীদের উদ্যোগে সাংবাদিক ও লেখক মুস্তাফিজ  শফি সংবর্ধিত
Logo
logo

শেষ আলোয় সিরাজুল আলম খান -শামসুদ্দিন পেয়ারা


খবর   প্রকাশিত:  ১৬ জুন, ২০২৫, ০৫:৪৪ পিএম

শেষ আলোয় সিরাজুল আলম খান  -শামসুদ্দিন পেয়ারা

শেষ আলোয় সিরাজুল আলম খান

-শামসুদ্দিন পেয়ারা

গতকাল (৮ জুন) সূর্যাস্তের আলো দেখতে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ-তে। সকাল এগারোটায়। গত কয়েকদিনের অসহনীয় তাপে ঢাকা মহানগর হাঁসফাঁস করলেও ওখানে তখন টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো। থিকথিকে কাদা জমে গিয়েছিল রাস্তায়। পরে সে বৃষ্টি শহরের সব এলাকায় আশীর্বাদ হয়ে ঝরেছআগে থেকে বলে রেখেছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সির গেটেই দাঁড়ানো ছিল রুবেল। বললো এপ্রন ছাড়া ঢোকা বারণ। আমি আর জালাল দুটো এপ্রন কিনে রুবেলের সাথে চললাম। ইমার্জেন্সির চার তলায়। লিফটের তিন।

আইসিইউর মুখে তিন চার জনের ছোট্ট জটলা। যে ভাস্তিটি তাঁর সাথে থাকতো, মানে এখনো থাকে, সে, দাদার ছোট বোন, আরো দুই কি তিন জন। আইসিইউতে ঢোকা নিষেধ। তবু ভাবলাম ঢুকবো। কেউ মানা করলো না। এপ্রন, ফেইস মাস্ক, হেড গিয়ার পরে নিলাম। ভিজিটর্স বুকে নাম লিখলাম। রুবেল বললো, ঢুকেই ডান পাশের বেডে। ঢুকলাম। দেখলাম সূর্য শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্বিপ্রহরের সেই প্রখর তেজ তো কবেই নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। তার আলো এখন একেবারেই ম্রিয়মান। কুপির আলোয় দেয়ালে কাঁপা ছায়ার মতো।

বিদায় লগ্নে কোথাও কোনো তোড়জোড় নেই। উপচে পড়া কান্না নেই। কোনো দীর্ঘশ্বাস নেই। আলো আছে, কিন্তু চারদিক থেকে আলকাৎরার মতো তরল কালো আঁধার তাকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে যে দেখলে মনে হয় আলো‌ যেন নিজেও অন্ধকারের কালো এপ্রনে সারা দেহ মুড়িয়ে নিয়েছে।রণক্লান্ত বিদ্রোহী শুয়ে আছেন স্থির প্রস্তরমূর্তির ন্যায়। সম্বিতহীন। দুটো চোখ বন্ধ। চেহারায় প্রচণ্ড কষ্টের ছাপ।বিরাশি বছরের জীবনের বলতে গেলে সবটুকুইতো ব্যয় করেছেন এদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও জনগণের কল্যাণে। স্বস্তি বলতে যা বোঝায় একদিনের জন্য‌ও তা পাননি। অসুরের মতো খেটেছেন। নাওয়া খাওয়া নিদ্রাহীন কাটিয়েছেন দিনের পরে দিন। পাকিস্তানের মতো মিলিটারি শাসিত একটা দেশে ছাত্র শ্রমিক ও যুব সমাজকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে তোলা যে কি অসাধ্যসাধনতূল্য কঠিন ব্রত তা ১৯৬০-এর দশকের সিরাজুল আলম খানকে যারা দেখেছেন, তাঁর সাথে যারা রাজনীতি করেছেন, কেবলমাত্র তারাই জানেন। অন্যেরা তা কল্পনাও করতে পারবেন না।

বেডের এ পাশে বসে আছেন সবার ছোট ভাই পেয়ারুর স্ত্রী, যিনি ব্যারিস্টার ফারাহ খানের মা। দু'তিন জন ডাক্তার বেডের ওপাশটায় মনিটরগুলোর দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হার্টবিট, প্রেশার, অক্সিজেন সেচুরেশন, টেম্পারেচার এসব দেখছেন। দু'জন ডাক্তার হাঁড়ের উপর চামড়া বসে যাওয়া পা দুটোতে কিছু একটা করার জন্য হাত ছোঁয়াতেই একেবারে শিশুর মতো চিৎকার করে উঠলেন। জ্ঞানহীন, তবু কষ্টের অনুভূতিটা আছে। মিনিট পনের তাঁর রোগশয্যাপাশে কাটিয়ে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলাম। কুল্লু নাফসিন যায়েকাতুল মাউত। সব জীবিতসত্ত্বাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

পরিণত বয়সে মৃত্যু অনভিপ্রেত বা অকাম্য কিছু নয়। তবে সে যেন নানাবর্ণের সুগন্ধ পুষ্পসাজেসজ্জিত হাস্যোৎফুল্ল প্রেমাস্পদের বেশে আসে। নির্যাতকের রূপে নয়।

জীবিত সিরাজুল আলম খানের সাথে আর দেখা হবে কি না জানি না। ১৯৬৬ সালে ছাত্র লিগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ঢাকায় তাঁর সাথে পরিচয়। ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা এগারো দফা আন্দোলন, ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন, জয় বাঙলা, স্বাধীনতার প্রথম পতাকা, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো, পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাঙলাদেশে জাসদের গঠন ও জাসদের সমর্থক দৈনিক গণকণ্ঠ প্রতিষ্ঠা ও তা'তে কাজ করতে গিয়ে তাঁর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছি। তাঁর স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি। গণকণ্ঠের মাধ্যমে সারাদেশে জাসদের প্রচার কাজে জড়িত থেকেছি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে সেই যে বিভোর হয়েছি সে ঘোর এখনো কাটেনি। কাটবেও না কখনো।

যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতা, সংগঠক ও যোদ্ধা ছিলেন তারা সব সময় সিরাজুল আলম খানকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখেছেন, অকপটে তাঁর অবদান স্বীকার করেছেন। স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্বে ছাত্র-শ্রমিকদের সংগঠিত করা, মুক্তিবাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ ইত্যাদিতে তাঁর মূখ্য ভূমিকার কথা বিনম্রচিত্তে স্বীকার করেছেন।

স্বাধীন বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তিনি শতভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এদেশের প্রথম গণসমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল জাসদ গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, স্বাধীন বাঙলাদেশে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসন পদ্ধতি বাতিল করে একটি স্বাধীন গণমুখী শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করার লক্ষ্যে পাকিস্তান আমলের প্রচলিত প্রশাসনব্যবস্থার বদলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করা। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা ক্ষমতার দম্ভ ও মোহের পাথরে কেবল নিষ্ফল মাথা কুটে মরেছে।

বাঙলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরেই যে নামটি সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হবে সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান কারিগর সিরাজুল আলম খান।

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পথে মনে হলো রোগ জরা যন্ত্রণা ও মৃত্যুর কাছে মানুষ কতোটাই না অসহায়! যদি দেখতাম উত্তর দেবার ক্ষমতা আছে তা'হলে একটাই শুধু প্রশ্ন করতাম - দাদা, যারা নিজেদের সব কিছু দিয়ে দেয় তারা নিশ্চয় কিছু একটা পায়। সে পাওয়াটা আপনিও নিশ্চয় পেয়েছেন। সেটা কি? সে প্রশ্ন হয়তো আর কখনোই তাঁকে করা হবে না।

ফেরার পথে জীবনানন্দের পংক্তিগুলো মাথার ভেতরে বকুল ফুলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছিলো,

"সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ!

এ জীবনে স্বপ্ন ছিল সত্য ছিল যাহা নিরুত্তর শান্তি পায়

যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে,

রোদ নিভে গেলে পরে পাখি পাখালির ডাক শুনিনি কি,

প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক?"